সম্প্রতি কেদারা সিনেমাটি দেখলাম। এই ছবিটি নিয়ে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। সুরকার ইন্দ্রদীপ দাসগুপ্ত যথেষ্ট কারণেই তার প্রথম ছবির জন্য কৃতিত্বের দাবি রাখেন।
সিনেমার জ্যরের কথায় প্রথমে আসা যাক। এটি একটি মিশ্রর জ্যরের ছবি। উদাহরণস্বরূপ কিছু দৃশ্য দেখে কেদারা দর্শকের মনে একটি পরাবাস্তববাদী ছবির ধারণা দেয়। আবার পরমুহুর্তেই ছবির কিছু ডায়ালগ দেখে মনে হয় এটি আসলে একটি ডার্ক কমেডি। আবার নরসিংহের নিঃসঙ্গতা দেখানোর সময় মনে হয় এটি একটি সোলো এক্ট ফিল্ম। এবং গোটা ছবি জুড়েই বিভিন্ন জ্যরের একত্র সহাবস্থান বেশ সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
![kedara moovie scene Koushik Ganguly Plays Beautifully in Kedara (কেদারা)](https://i0.wp.com/www.cinemamonogatari.com/wp-content/uploads/2021/07/Screenshot-26.png?resize=1024%2C576&ssl=1)
কেদারা মধ্যবয়সে উপনীত একজন নিঃসঙ্গ মানুষের জীবনশৈলীর কথা বলে। যদিও গল্পের মূল চরিত্র নরসিংহ একজন হরবোলা। তিনি বিভিন্ন জীবজন্তু ,পাখি ও মানুষের আওয়াজ নকল করতে পারেন।নরসিংহের জীবন বর্তমানে আটকে থাকলেও তার নিঃসঙ্গতা কাটাতে সে নিজের সাথে নিজেই কথা বলে, তার ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করে, হেমন্তসঙ্গীত শোনে।
সারাজীবন ধরে নরসিংহ ব্যর্থতার বোঝা বয়ে চলে। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন।এবং তার প্রতিবেশী জ্ঞানদা মাঝেমাঝেই তার বাড়িতে এসে তার জীবনের ব্যর্থতার কথা তাকে মনে করিয়ে দিয়ে যান। পাড়ার চায়ের দোকানের লোফাররা তার জীবিকা ও কর্মহীনতা নিয়ে তার সামনেই মশকরা করে। তার বাড়ির পরিচারিকা মেনকা তাকে উঠতে বসতে কথা শোনায়। নরসিংহ তাদের কোনও প্রত্যুত্তর দিতে পারে না।
বাংলা ছায়াছবির এই কঠিন সময়ে, যে কয়েকটি ছবি দর্শকদের মনে আশা জোগায়, কেদারা অনায়াসেই তাদের মধ্যে নিজের জায়গা তৈরি করে নেয়।
![reference নরসিংহের ভূমিকায় কৌশিক গাঙ্গুলি (কেদারা)](https://i0.wp.com/www.cinemamonogatari.com/wp-content/uploads/2021/07/কেদারা-1.png?resize=1024%2C568&ssl=1)
নরসিংহের জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটে যখন তার প্রতিবেশী বন্ধু কেষ্ট তাকে জমিদারবাড়ি থেকে একটি কেদারা এনে দেয়। তার চরিত্রে অজান্তেই জমিদারী মেজাজ ঢুকে পড়ে। নরসিংহ তার আশেপাশের প্রতিটি মানুষকেই প্রত্যুত্তর দিতে থাকে, যারা তাকে এতদিন ধরে কথা শুনিয়ে গেছে। সব মানুষই কোনও না কোনওভাবে ব্যর্থ, তবে বারবার তার ব্যর্থতার কথা বলে বলে তার কোনও উপকার করা যায় না। এই কথাই যেন বারবার বোঝাতে চেয়েছেন নারাসিংহ।
অভিনয়ের কথা বলতে গেলে কৌশিক গাঙ্গুলির জীবনের সেরা অভিনয় এটি। যেমন তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে ছবি ফুটিয়ে তোলেন এক চিত্রশিল্পী ,তেমনই পর্দায় ফুটে উঠেছে নরসিংহ চরিত্রটি। মাঝেমাঝে মনে পড়ে যায় ‘চতুষ্কোণ’ ছবিতে তারই অভিনীত প্রযোজক চরিত্রটির কথা। রুদ্রনীল ঘোষ কেষ্টর ভূমিকায় বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। নরসিংহের স্ত্রী-এর ভূমিকায় বিদিপ্তা চক্রবর্তী স্বল্প সময় পেলেও তার অভিনয় যথাযথ।
পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাসগুপ্ত ও লেখক শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের অসাধারণ দক্ষতায় নরসিংহ চরিত্রটিকে তৈরী করেছেন। বিভিন্ন জ্যরের মধ্যে দিয়ে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, কিছু কিছু জায়গায় ফ্ল্যাশব্যাক সবটাই বেশ মসৃণভাবে লেখা হয়েছে। ছবির শেষে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের কন্ঠে শ্রীজাতর কবিতা দর্শকদের বাড়তি পাওনা।
![kedara movie scene Narasingha and Kesto in কেদারা](https://i0.wp.com/www.cinemamonogatari.com/wp-content/uploads/2021/07/Screenshot-25.png?resize=1024%2C576&ssl=1)
সিনেমাটোগ্রাফার শুভঙ্কর ভড় ও এডিটর সুজয় দত্ত একটি উদাহরণ তৈরী করে দিয়ে গেলেন গোটা ছবি জুড়ে। নিঃসঙ্গতা ও কেদারা আসার সাথে চরিত্রের পরিবর্তন অনুযায়ী আলোর ব্যবহার চোখে পড়ার মত। বদ্ধ পরিবেশ বোঝাতে ছবির কালার টোন ডার্ক রাখা হয়েছে। ছবির প্রয়োজন অনুযায়ী প্রচুর ক্লোজ-আপ শট রাখা হয়েছে নরসিংহ চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে। মধ্যবয়সে উপনীত নরসিংহের সাথে তার ছোটবেলার তুলনা তার মধ্যেকার শিশুর সারল্যকে তুলে ধরা হয়েছে।
২০১৩ সালের শব্দ সিনেমাকে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছানো সেই অনির্বাণ দাসগুপ্ত ছবির সাউন্ড ডিসাইন করেছেন।নরসিংহের মনের শূন্যতার প্রতিফলন ঘটে পিয়ানো, বেহালার মাধ্যমে। যেহেতু ছবিটি মূলত চরিত্রনির্ভর, তাই শব্দ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েই ফেলে। ছবিতে শব্দের ব্যবহার অত্যন্ত পরিমিত এবং কখনই সেটা চিরাচরিত বাংলা ছবিগুলোর মতো অপ্রয়োজনীয় আতিশয্যে ভরে ওঠেনি।
মোদ্দা কথা নরসিংহর মনের হদিশ এবং একটি ব্যতিক্রমী বাংলা ছবি পেতে ‘কেদারা’ সিনেমাটি দেখতে ভুললে চলবে না।
Further Reading: https://www.cinemamonogatari.com/games/